আজ, শনিবার | ১৮ই মে, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ | দুপুর ১:২০

ব্রেকিং নিউজ :

জননেতা আছাদুজ্জামান : আমার পিতা, আমার রাজনৈতিক আদর্শ

মো. সাইফুজ্জামান শিখর : জননেতা অ্যাডভোকেট মো. আছাদুজ্জামান। আমার প্রয়াত পিতা। আমার চলার পথের আজীবন অনুপ্রেরণা ও বিশ্বাস। যিনি ছিলেন সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের এক অগ্রসেনা।

জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বের প্রতি অবিচল থেকে যোগ্য নেতৃত্ব, সততা এবং জনগণের ভালোবাসায় যিনি অন্যান্য অসাধারণ এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। মাগুরার ধুলিধূসর পথে এই নামটি এখনও অমর হয়ে আছে। এক দীর্ঘ সময়কে জয় করা এই জননেতার রাজনৈতিক জীবনে রাজসিকতা ছিল না-শুধুমাত্র নেতৃত্ব, সততা ও গুণাবলী তাঁকে ঠাঁই করে দিয়েছিল সর্বস্তরের জনগণের হৃদয় মন্দিরে। প্রকৃতার্থেই তাই জনগণের প্রিয় ও সর্বশ্রদ্ধেয় এক নেতা হয়ে উঠেছিলেন তিনি। পরেছিলেন জনগণের দেওয়া ভালোবাসার রাজমুকুট। মৃত্যুর পরেও সেই মুকুট আর কেউ কেড়ে নিতে পারেনি।

ষাটদশকে তাঁর সংগ্রামী রাজনৈতিক জীবনের সূচনা হয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন তারুণ্যেই। সেসময়ই স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই স্বপ্নের পথে প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে ছিলেন নিবেদিত এক প্রাণ। পাকিস্তানের সামরিক সরকার বিরোধী আন্দোলনে তাঁর অবদান ছিল অসামান্য। তারুণ্যেই তত্কালীন মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পেয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধপূর্ব ৭০ সালে তিনি প্রথম বারের মতো প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এরপর একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে মাগুরা মহকুমা সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসেবে ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধকে এগিয়ে নিতে রান্নাঘাট যুবশিবিরের দায়িত্ব পালন করেন। ছিলেন বাহাত্তরের গণপরিষদের সদস্য, জাতীয়ভাবে ঐ পরিষদের তরুণ ও শ্রেষ্ঠ পার্লামেন্টারিয়ান হিসাবেও পুরস্কৃত হয়েছিলেন। আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কান্ডারি হিসেবেও তাঁর সাহসী ভূমিকা এখনও উজ্জ্বল এবং স্মরণীয়।

৭৫-এর ১৫ আগস্ট পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগের সবচেয়ে দুঃসময়ে তিনি ছিলেন সোচ্চার এবং প্রতিবাদী এক সাহসী কন্ঠস্বর। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার প্রতিবাদ করায় এবং খুনীদের প্রতিরোধের ঘোষণা দেওয়ার তত্কালীন শাসকচক্র তাঁকে জেলে পাঠিয়েছিলেন। দীর্ঘ নয়মাস তিনি কারাবন্দী ছিলেন।

৭৫ পরবর্তীতে সাধারণ জনগণের ভালোবাসা আর আস্থায় আছাদুজ্জামান জনগণের মধ্যমণিতে পরিণত হন। এ কারণে দলীয় মনোনয়ন পেয়ে প্রতিবারই সব বাধাবিপত্তি পেরিয়ে সাধারণ মানুষের ভোটের রায়ে বিজয়ের মালা পরেন। ৭৯ সালে জিয়ার আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনে নানা প্রতিকূলতা আর শাসকদলের ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অনেক প্রার্থী পরাজিত হলেও পিতা আছাদুজ্জামান ছিলেন অপরাজেয়। রাজনৈতিক চরম প্রতিকূলতা এবং বিরুদ্ধ স্রোতধারা ঠেলে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে বৃহত্তর যশোর জেলা থেকে তিনি কেবল এ নির্বাচিত হয়েছিলেন।

সেবার ক্ষমতা কুক্ষিগত করে জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকার রাজনীতিকে কুক্ষিগত এবং আওয়ামী লীগকে নেতৃত্ব শূন্য করতে শত পথ তৈরি করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভূলণ্ঠিত করে রাজনীতির কঠিন এবং ষড়যন্ত্রময় করে তুলেছিলেন। বিস্তর সুযোগ-সুবিধার পথ প্রশস্ত করে রাতের আঁধারে তাই অনেককেই দলে টেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু পিতা আছাদুজ্জামান মুজিব আদর্শের প্রতি বিশ্বস্ত এবং অটল থেকে কখনই সেই বিচুতির পথে যাননি। বরং জিয়াউর রহমানের শাসনামলে যখন অনেকেই নিশ্চুপ থেকেছেন তখন শাসকদলের দেওয়া সব প্রলোভনকে তুচ্ছ করে সংসদের ভেতরে ও বাইরে তিনি ছিলেন উচ্চকিত এক কণ্ঠস্বর। দৃঢ়তার সাথে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন, প্রতিবাদ করেছেন, প্রতিরোধের ঘোষণা দিয়েছেন। দৃঢ়কণ্ঠে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হত্যার বিচার চেয়েছেন মহান সংসদে দাঁড়িয়ে। একইভাবে এরশাদের আমলেও তাঁর দৃঢ়চেতা রাজনৈতিক অবস্থান তাঁকে অমরত্ব দান করে। মৃত্যু অব্দি সেই দৃঢ়তার অলংকারই শোভিত ছিল তাঁর গলে।

৮৬ সালে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে তিনি বিপুল ভোটের ব্যবধানে জয়ী হন। এরপর ৯১ সালে বিএনপির অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) মজিদ উল হককে পরাজিত করে সংসদে বসেন তিনি। বিস্ময়কর হলো- যে কয়বার তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন সেটা বরাবরই বিরোধী দলের একজন নেতা হিসেবেই হয়েছেন, সরকারি দলের নেতা হিসেবে নয়।

পিতা আছাদুজ্জামান বরাবরই ছিলেন জাতীয় সংসদের এক প্রাণবন্ত আলোচক। দক্ষ পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সর্বত্র। সবসময়ই তাঁর কণ্ঠস্বর সরব ছিল জাতীয় সংসদে। তাঁর কণ্ঠে বরাবরই প্রতিধ্বণিত হয়েছে বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা এবং এ দেশের মাটি আর মানুষের অধিকারের কথা। রাজনীতির অধিকারহরণের কালে তিনি বরাবরই শাসক চক্রের মনে করিয়ে দিয়েছেন ন্যায়, ন্যায্যতা, গণতন্ত্র এবং সংগ্রামের কথা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও দর্শনকে তিনি বারবার সবাইকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। মহান সংসদে দাঁড়িয়ে তথ্য-উপাত্ত আর যুক্তির সৌন্দর্য ছড়িয়েছেন সবসময়। সহজ এবং প্রাঞ্জল ভাষায় বক্তব্য দিতেন। বাকপটুতায় ছিলেন অনন্য। সংসদীয় রীতি-নীতির প্রতি তিনি ছিলেন প্রচন্ড শ্রদ্ধাশীল। প্রখর বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে রাজনৈতিক বক্তব্য তুলে ধরতেন। এ কারণেই টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছিল তাঁর কণ্ঠস্বর। জাতীয় সংসদে দেওয়া তাঁর বক্তব্যগুলো পড়লে বুঝা যায়- সমাজ, সাংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক অধিকার সম্পর্কে তাঁর উপলব্ধির গভীরতা কতোটা ছিল। আমার মনে আছে পিতা আছাদুজ্জামান যখন সংসদে দাঁড়িয়ে বক্তব্য দিতেন তখন গ্রাম বাংলার অনেকেই তাঁর কণ্ঠস্বর শুনতে রেডিও খুলে বসে থাকতেন। আমি মনে করি জাতীয় সংসদে পিতা আছাদুজ্জামান যে সব বক্তব্য প্রদান করে গেছেন ঐতিহাসিক বিবেচনায় সেগুলো অন্যরকম তাৎপর্যবহন করে। তাঁর ঐতিহাসিক মূল্যও রয়েছে।

৯৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর পিতা আছাদুজ্জামান অকস্মাত্ আমাদের সবাইকে ছেড়ে চলে যান চিরকালের জন্যে। কিন্তু তিনি চলে গেলেও রেখে গেছেন অনেককিছু। তাঁর সেই যুক্তিপূর্ণ, সৃজনশীল, আলোকময় বক্তব্য-এখনও প্রতিধ্বণিত হয়ে সর্বত্র। আছাদুজ্জামান এদেশ এবং এদেশের সাধারণ মানুষের বড় বেশি ভালোবাসতেন। মাগুরার সাধারণ জনগণ ছিল তাঁর কাছে আরও বেশি প্রিয়। মাগুরার গ্রামেগঞ্জের অলিগলিতে গেলে আমি তা টের পাই। পিতার ২৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছি। আমিও তাঁর মতোই মাটি আর মানুষের কাছেই কেবল যেতে চাই। আমার পিতা, আমার আদর্শ। পিতার মতোই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক দর্শন বুকে লালন করে তাঁরই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার দেখানো পথে হেঁটে যেতে চাই অনেক দূর।
-মো. সাইফুজ্জামান শিখর, সংসদ সদস্য

শেয়ার করুন...




©All rights reserved Magura Protidin. 2018-2022
IT & Technical Support : BS Technology